কাপ্তাই লেক দেখবো বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। পথে একটি বড় বাসকে সাইড দিতে গিয়ে আমাদের ছোট বাহনটি উলটে যায়। অতর্কিতে টাল সামলাতে না পেরে পথপাশে কোথাও পড়ে যাই। তারপর আর খেয়াল নেই। যখন চোখ মেলি, দেখি একটি মুখ আমার মুখের উপর ঝুঁকে আমাকে ডাকছে। চোখ বন্ধ করে ফেলি। আবার তাকাই। দেখি স্বপ্ন নয় বাস্তব! ছেলেটি প্রাণপণে আমাকে ঝাঁকাচ্ছে।
-এই যে, এই যে তাকান। তাকিয়ে দেখুন আপনার কিছুই হয়নি। আপনি ভাল আছেন।
আমি চোখ মেলে এক ঝটকায় উঠে পড়তে চাইলাম। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ। একটু শক্তি সঞ্চয় করে উঠে বসলাম। অপ্রস্তুত আমি। যার কোলে মাথা রেখে এতক্ষণ ছিলাম তাকে ধন্যবাদ জানালাম। সে বললো,
- এমন কিছু করিনি। আপনি একা। সঙ্গে কাউকে দেখছি না। পথপাশে পড়ে আছেন। তাই এটা আমার দায়িত্ব আপনাকে দেখা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন কয়া। ভাগ্য ভাল আপনার তেমন কিছু হয়নি। প্রচন্ড শকে আপনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আমি তবে যাই এখন? আপনার নামটা জানতে পারি কি?
- আমার নাম আন্না।
- আন্না? আর কিছু না? অদ্ভুত বটে!
-কেন আগে শোনেন নি?
- নাহ! বিশ্বাস হচ্ছে না।
- এই তো আমি আন্না। টলস্টয়ের লেখা আনা কারেনিনার নাম শোনেননি?
-ও আচ্ছা! তবে ঠিক আছে।
- আপনার নামটি তো জানা হলো না।
- আমার নাম ক্রিস। কৃষ্ণা কানাইয়া।
-দুষ্টুমী করছেন?
-না । তবে একটা নাম আছে খাতায়। খুব জমকালো। তাই এই নামেই সবাই ডাকে।
- কি নাম সেটা? অদৈত মল্ল বর্মন নয়তো?
- হেসে বললো, না, মোহাম্মদ জাকারিয়া খান।
সেদিল আর কাপ্তাই যাওয়া হলো না। একটি অটোরিক্সায় উঠে বাসায় ফিরে এলাম। এরমধ্যে বেশ কিছুকাল কেটে গেল। আমি ঢাকায় গ্রামীন ফোনে কাজ করি। হঠাত একদিন দেখি সেই চেনা মুখ। একটি দেরি হলেও সে চিনলো। মৃদু হেসে বললাম, কি করতে পারি? তার সমস্যার কথা শুনে তাকে অন্য একজনের কাছে নিয়ে গেলাম। কাজ শেষে সে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। আমার যেন কেমন সব ওলোট পালোট হয়ে গেল। বুকের ভেতর ঝড় উঠলো। কেবলই তার কথা মনে পড়ছে।
বাসায় এলাম। নানা কাজে মন দিলাম। তবুও রেহাই নেই। কি যে করি, কোথায় যাই, কাকে বলি, কোথায় তার দেখা পাই! দিন দিন যেন অসুস্থ হয়ে পড়ছি। কিছুই ভাল লাগেনা।
হঠাত একদিন ও আবার অফিসে এসে হাজির । আনন্দে আমার ‘বক্ষ মাঝে চিত্ত আত্মহারা, নাচে রক্তধারা।‘ বললাম,
-আবার কি সমস্যা।
বললো,
-এবার সমস্যা গুরুতর। ফোন নাম্বার মনে থাকছে না। তাই ভাবলাম কোথাও রেখে আসি। তার মানে এই ধরুন আপনার কাছে রেখে যাই। ভুলে গেলে আবার এসে নিয়ে যাব।
বুঝলাম দুষ্টুমী করছে। বললাম,
-আমি যদি ভুলে যাই। তখন কি হবে?
-লিখে রাখেন তবেই আমার উপকার হবে।
আমি সানন্দে ফোন নাম্বার লিখে নিলাম। সে চলে গেল। একটু পরেই ক্রিসকে ফোন করে জানতে চাইলাম,
-আপনার নাম্বার ঠিক আছে তো? তাই পরখ করে দেখছি। বিরিক্ত বোধ করেন নি তো?
- করেছি বটে তবে বেশী নয়। মাঝে মাঝে এরকম বিরক্ত করলে খুশী হব।
এরকম ছোটখাট কথোপকথন হতে থাকে প্রায়ই।
আমার কি হয়েছে? তাকে দেখার জন্য আমার আঁখি দুটি ব্যাকুল হয়ে ফেরে। ফোনে বললাম, অমুকদিন, সেইসময়, বাণিজ্য মেলার গেইটে থাকবেন। গিয়ে দেখি ঠিক অপেক্ষা করছে। ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরি পরম সুখে! কিন্তু তা তো হবার নয়।
-চলুন ভেতরে।
ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু দেখলাম। খাবার খেলাম, গেইটের কাছে ফেরতও এলাম। সে বললো,
-বাজার সে গুজারা, লেকিন কুছ খারিদা নেহি।
চমকে উঠে বললাম,
-ওরে বাপরে আপনি তো দেখি মির্জা গালিব! অনেক গুণ আপনার!
হেসে বললো,
-আরো গুণ আছে!
প্রায়ই আমাদের অভিসার চলতে থাকে বিভিন্ন মার্কেটে, মেলায়, বোট্যানিকাল গার্ডেনে। আমরা যেন একজন আরেকজনের আত্মায় মিশে গেছি। কিন্তু একবারও বলা হলনা, ‘ভালবাসি।’ এখন আমরা হাত ধরে হাঁটি।
ক্রিস আমাকে একদিন বললো,
- কাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে, মনে আছে তো?
- বললাম, নাহ্ ! মনে নেই তো।
- মনে করিয়ে দিলাম। দেখ না চারিদিকে কেমন সাজ সাজ রব। যেন মহা মানবের মহা মিলনের মহেন্দ্রক্ষণ জাগ্রত দ্বারে। রঙ বেরং এর জুটিরা সব প্রজাপতির মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। সর্বত্র, বিশেষ করে এই রমনার উদ্যানে। আমরা আলোর পাখি। এই রমনার উদ্যানে, এই ইডেন গার্ডেনে বেড়াতে এসেছি গন্দম বৃক্ষের ফল টেস্ট করতে। আগামীকাল থেকে আমরা মানুষ হয়ে যাব। কাল তোমার জন্য লাল গোলাপ নিয়ে আসব।
আমি বললাম,
- বাগানের গোলাপ, নাকি কাগজের?
- কাগজের। দিনের পর দিন কাগজ কেটে নিজের হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে পাপড়ি রেণু তৈরি করে, এক সাথে গেঁথে ফুল বানাবো। তারপর গোলাপের সুবাস মাখিয়ে তোমার জন্য নয়ে আসব। সে ফুলের পাপড়ি তাজা থাকবে শুকাবে না। ঝরে যাবে না। সুগন্ধ আমার কথা বলবে তোমার কানে কানে। সেটাই তো ভাল।
- না ভাল নয়। আমি চাই তাজা গোলাপ। ভারি ভেলভেটের মত কালচে লাল পাপড়ি, সকালে ফুলদানির চারিপাশে পড়ে থাকবে। তার থেকে বড় বড় পাপড়ি তুলে আমার কৃষ্ণা কানাইয়ের নামটি যত্ন করে লিখে রেখে দেবা আমার মনের মন্দিরে, সঞ্চয়িতার পাতার ভেতরে আর ডিকশনারিতে।
- ডিকশনারিতে? কেন?
-সেখানে আমি যখন তখন তোমার নামের অর্থ খুঁজি, বানান দেখি!
-অবাক কান্ড! আচ্ছা দেখা যাবে কাল ভালবাসা দিবসে!
পরের দিন রমনা গার্ডেনে নির্দিষ্ট সময়ে আন্না আর ক্রিস হাজির। লাল গোলাপের বিরাট তোড়া দেখে আন্না বিস্ময়ে বলে উঠলো, এটাতো হাজার গোলাপের তোড়া! ভাবতে পারছি না কিছুই!
ক্রিস বললো,
-আজ পৃথিবীতে যত ফুল ফুটেছে সব তোমার জন্য, সব তোমাকে দিলাম আন্না, বলে নতজানু হয়ে ওকে অভিবাদন জানাবার সময় আন্না তাকে জড়িয়ে ধরে তুলে নিল। অনামিকায় ক্রিসকে দেবার জন্য একটি গোলাপের পাপড়ি যুক্ত সোনার আংটি এনেছিল। সেটি আর দেবার সুযোগ পেলনা। ততক্ষণে আন্না ক্রিসের আলিঙ্গন পাশে আবদ্ধ। আন্নার দুবাহু বেষ্টন করে রেখেছে ক্রিসকে স্বর্ণলতার মত। দুজনেই উচ্চারন করলো happy valentine's day!
ক্রিস বললো, you are my love. I love you my love. Happy Love day Anna, I love you, I love you today and forever.
আন্না যে কোন স্বপ্নের দেশের হারিয়ে গেছে তা সে জানে না। কেবল এক বিচিত্র অনুভূতি, আবেগে সে বারবার শিহরিত হচ্ছিল। এ এক অনির্বচনীয় আনন্দ। দুজনার ভালবাসার স্রোত এই ভ্যালেন্টাইন্স দিবসে এক হয়ে মিশে গেল। তাদের অন্তরঙ্গ আশ্লেষে গভীর প্রেম একজনের অন্তর থেকে অন্যজনের অন্তরাত্মায় সঞ্চারিত হল। নিবিড় বাহু বন্ধনে আন্নার ব্যাকুল কন্ঠ কি যেন বলতে চাইলো । ক্রিস বললো, Please hold your tounge and let me love.
লিখেছেনঃ ফিরোজা হারুন





7:39 PM
Admin
Posted in:
0 comments:
Post a Comment
এই লেখাটি ফেইসবুকে শেয়ার করতে ফেইসবুক আইকনে/বাটনে ক্লিক করুন।
মন্তব্য করার ক্ষেত্রে বন্ধুসুলভ আচরণের অনুরোধ রইলো।